• সোমবার ০৬ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

  • || ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

আলোকিত ভোলা
ব্রেকিং:
ঢাকা সেনানিবাসে এএফআইপি ভবন উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী উপজেলা নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে কাজ করতে মন্ত্রী-এমপিদের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর আমাকে সরিয়ে তারা কাকে আনবে? যে ২৫ জেলায় আজ স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে যুক্তরাষ্ট্রকে আগে নিজের ঘর সামলাতে বললেন শেখ হাসিনা থাইল্যান্ডের সঙ্গে অংশীদারত্বের নতুন যুগের সূচনা হয়েছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে থাইল্যান্ড সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ডিক্টেটর মিলিটারির পকেট থেকে বের হয়নি আওয়ামী লীগ দেশে এখন বেকারের সংখ্যা ৩ শতাংশ: প্রধানমন্ত্রী ‘বিলাসিতা একটু কমিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণে নজর দিন’ চীন সফরে যাওয়ার আগে জুলাইয়ে ভারত সফর করবেন প্রধানমন্ত্রী ছয় দিনের সফর শেষে দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী হিট অ্যালার্টের মেয়াদ বাড়লো আরও ৩ দিন সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর: শেখ হাসিনা কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধি নিশ্চিতে কাজ করতে হবে বাংলাদেশ-থাইল্যান্ডের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে দেশ ও জনগণের উন্নয়নে কাজ করতে হবে: নেতাকর্মীদের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত : প্রধানমন্ত্রী থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা থাইল্যান্ডের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী

সুনীল অর্থনীতি ও বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন

আলোকিত ভোলা

প্রকাশিত: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

কয়েক দিন আগে ঢাকায় সুনীল অর্থনীতি বিষয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ভারত সাগর রিম অ্যাসোসিয়েশন (আইওরা) দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। গুরুত্বপূর্ণ এই সম্মেলনের উদ্বোধন করার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বিশেষ করে, টেকসই উন্নয়নের মর্মার্থ মাথায় রেখে তিনি সুদূরপ্রসারী কিছু মন্তব্য করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য ২০১৫ সালে প্যারিসে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও আমাদের সবুজমনা প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্বমূলক ভূমিকা রেখেছিলেন। আগামী প্রজন্ম ও আমাদের প্রিয় পৃথিবীকে বাঁচানোর যে বিশ্ব নৈতিক ঐকমত্য প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে প্রতিফলিত হয়েছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ফের আমরা লক্ষ করলাম সুনীল অর্থনৈতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে। সবুজ পৃথিবী সংরক্ষণের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত অন্যতম চ্যাম্পিয়ন শেখ হাসিনার এই বিচক্ষণ বক্তব্য মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘সুনীল অর্থনীতিকে সামনে রেখে সমুদ্রে অব্যবহৃত ও এর তলদেশে অ-উন্মোচিত সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে এই অঞ্চলে যার যার টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করার সুযোগ রয়েছে।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘শান্তি, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের মধ্যে একক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে গিয়ে যেন সমুদ্রের সুস্থ পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়। তাই আমাদের সুনীল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সুনীল চিন্তাও করতে হবে এবং সে লক্ষ্যে সমন্বিত, লাভজনক ও সর্বোপরি সমুদ্র সংরক্ষণমূলক নীতি নির্ধারণ ও সে অনুযায়ী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে।’ একই সঙ্গে তিনি এই আশার বাণীও উচ্চারণ করেন যে ‘২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৯ বিলিয়ন মানুষের জীবন ধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এই সুনীল অর্থনীতিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।’

 

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুনীল অর্থনীতি নিয়ে এমন আশা-জাগানিয়া কথা বলতেই পারেন। কেননা তাঁরই দৃঢ় হস্তক্ষেপের কারণে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ জার্মানির সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অর্জন করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে অনুরূপ আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ভারত থেকেও বিপুল পরিমাণ সমুদ্রাঞ্চল অর্জন করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে এভাবে বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রাঞ্চল অর্জন করে। আর সে কারণেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় অনুষ্ঠিত আইওরা লিডার্স সামিটে আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকার করেছিলেন। সেই অঙ্গীকারের প্রতিফলন আমরা হালের ঢাকা সম্মেলনেও দেখতে পেলাম।

নয়া বিশ্ব বাস্তবতায় সুনীল অর্থনীতির গুরুত্ব যে আরো বাড়বে ঠিকই তিনি তা অনুমান করেছেন। উল্লেখ্য, বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের কর্মকাণ্ড হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ শতাংশ আমিষের জোগান দিচ্ছে সমুদ্রের মাছ ও উদ্ভিদ। বিশ্বের ৩০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি তেল আসছে সাগর থেকেই। পণ্য পরিবহনের বড় অংশই সমুদ্রনির্ভর। অস্ট্রেলিয়া ৪৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে সমুদ্র থেকে। ২০২৫ সাল নাগাদ অস্ট্রেলিয়া সমুদ্র থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় করার পরিকল্পনা করেছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির বেশির ভাগই সমুদ্রনির্ভর। আমাদের পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমার প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ শুরু করেছে। সেই বিচারে আমরাই বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি। আমাদের এই পিছিয়ে পড়ার জন্য বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে। আইনিকাঠামোর অভাব, প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতি, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ভেতর সমন্বয়ের অভাব, প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতার ঘাটতির মতো অনেক সীমাবদ্ধতা আমাদের সুনীল অর্থনীতির বিকাশের বড় বাধা হয়েই রয়ে গেছে। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী করার কাজ এগিয়ে চলেছে। বিশেষ করে, খুব তাড়াতাড়ি সুনীল অর্থনীতি বিকাশের জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষ স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েই স্থাপন করার প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে সমন্বিত করার কাজ এই কর্তৃপক্ষকেই করতে হবে। এ জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। নিশ্চয়ই তিনি এই নীতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং সময়মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

 

সমুদ্র আমাদের প্রাণের উৎস। শুধু অর্থনৈতিক সম্পদের জন্য নয়, আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির উৎসও সুনীল সমুদ্র। আসলে আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে এক বিশাল সাগর। লালনও এমনটাই বলে গেছেন তাঁর গানে, সৃষ্টিতে। তাই এই ভাবনার আলোকে বলতে ইচ্ছা করে, সম্প্রতি বাংলাদেশেও সুনীল অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তা ও পরিবেশবাদী নতুন প্রজন্মের মনে নানা স্বপ্ন ও ধারণা ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে আমাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরপরই আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্রসম্পদ উন্নয়নে রূপকল্প দিয়েছেন। সেই রূপকল্পের আলোকেই আমরা এক নতুন স্বপ্নের সন্ধান করছি এখন। সমুদ্র বিজয়ের ফলে দেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের এখতিয়ার অর্জন করেছে। এই বিশাল সমুদ্রাঞ্চলের প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যকে যথোপযুক্ত উপায়ে সুরক্ষা করে কিভাবে আমাদের চলমান অগ্রগতির দুর্বার গতিকে আরো ত্বরান্বিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়, তারই পরিকল্পনা এখন করা হচ্ছে। প্রাপ্ত এই সমুদ্রাঞ্চলের দায়িত্বশীল ব্যবহারের ফলে আগামী দিনে নিঃসন্দেহে অনেক ধরনের টেকসই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো ও সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটবে। সেসব স্থাপনাও যেন সবুজ ও টেকসই হয়, সেই প্রত্যাশা আমরা সবাই করছি।

 

কক্সবাজার, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পটুয়াখালী, খুলনা, মোংলা অঞ্চলে এসব কর্মকাণ্ড আমরা দেখতে পাব। সমগ্র সামুদ্রিক ও উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক মাছ আহরণ, অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর যথাযথ সংরক্ষণ ও টেকসই আহরণ, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলসহ সাগরতলের ঘাসের কার্বন শোষণ, সামুদ্রিক লবণ উৎপাদন, পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য সামুদ্রিক জ্বালানি, সামুদ্রিক বাণিজ্য, জাহাজ ও পরিবহন, সামুদ্রিক পর্যটন, শিক্ষা, গবেষণা, স্থাপত্যশিল্পসহ নানামাত্রিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ ঘটবে বলে আশা করছি।

 

সম্ভাবনাময় ও উন্নয়নমূলক সব কাজের সময়ই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রকৃতির দান আমাদের সীমিত সমুদ্রাঞ্চলে প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতিসাধন না হয়। সমুদ্রে কিভাবে এসব উন্নয়ন করলে আমাদের কল্যাণ আর কিসে ক্ষতি, সেই ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা দিতে পারে সমুদ্র-সাক্ষরতা।

 

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের জ্ঞান আর প্রকৃতির দান—এ দুইয়ে মিলেই সৃষ্টি হয় সভ্যতা। আমরা যেন তাই অতি লোভে এই সম্পদের কোনো ক্ষতি করে না ফেলি। টেকসই ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের দিকে তাই গভীর মনোযোগ দিতে হবে। সে কথাগুলোই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি উচ্চারণ করেছেন। আমাদের সমুদ্রে, সমুদ্র উপকূলে বা তার আশপাশে যা কিছুই নির্মাণ করি না কেন, আমরা যেন পরিবেশ সংরক্ষণের মাপকাঠিতে উতরে যাই। আমরা কাজ করতে গিয়ে কখনোই যেন প্রকৃতির সঙ্গে অসহিষ্ণু আচরণ না করি বা অন্যদের এমন আচরণে উৎসাহিত না করি।

 

অনেক সময় আমরা দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও লাভের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারি না। প্রাত্যহিক জীবনের লাভের জন্য আমরা ভবিষ্যতের সম্ভাবনাগুলোকে ধ্বংস করে ফেলি। সে জন্য আমাদের মনে রাখতে হবে, টেকসই উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই।

 

আমরা যদি প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো পরিকল্পিতভাবে নিতে ব্যর্থ হই, তাহলে অপরিকল্পিত অবকাঠামো ও সিদ্ধান্তগুলো একসময় সুনীল অর্থনীতির জন্য নতুন কর্মকাণ্ডের সুযোগ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হবে এবং আগামী দিনের পৃথিবী ও প্রজন্মের জন্য বিরাট সংকট সৃষ্টি করবে। এই ক্ষতি পরবর্তী সময়ে পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।

 

তাই আমাদের প্রিয় পৃথিবী ও নতুন প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, সুনীল অর্থনীতির জন্য, আমাদের মাটির জন্য, আমাদের সমুদ্রের জন্য, আমাদের প্রাণের বৈচিত্র্যের জন্যই আমাদের আগামী দিনের স্লোগান হতে হবে : প্রকৃতিসহিষ্ণু ও প্রকৃতিবান্ধব অবকাঠামো নির্মাণ করেই আমরা আমাদের সমুদ্রবান্ধব সুনীল অর্থনীতির বিকাশ ঘটাব।

 

এই প্রক্রিয়ায় সরকার ও সমাজকে অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি আমরা। বিশেষ করে, সরকারের কাছে এই আহ্বান জানাচ্ছি যে সরকার ও সমাজ উভয়কেই অংশীদারির ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে তা বাস্তবায়নে আন্তরিক হতে হবে। আমি মনে করি, আগামী দিনের বাংলাদেশ, বিশেষ করে সুনীল প্রকৃতি ও সমুদ্র রক্ষার দায়িত্ব তরুণ প্রজন্মের। কেননা আগামী দিনের বাংলাদেশ তাদেরই। তাই তাদের খুবই সচেতন ও দায়বদ্ধ থাকতে হবে।

এ কথা মনে রাখতে হবে যে সমুদ্র শুধু অর্থনৈতিক সম্পদই উৎপাদন করে না, পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কিত নানা সেবাও প্রদান করে। বাজারমূল্যে সমুদ্রের এই অবদান হিসাব করা মুশকিল। তাই সনাতন অর্থনীতিবিদদের হিসাবে বাজারবহির্ভূত সমুদ্রসম্পদের মূল্য অনেক সময়ই ধরা পড়ে না। বিশেষ করে, সম্পদের অতি উত্তোলনের কারণে পরিবেশের যে ক্ষতি হয়, তা ধরতে পারা মোটেও সহজ কাজ নয়। সে কারণেই প্রাকৃতিক যে পুঁজি সমুদ্র সংরক্ষণ করে, তাকে সুরক্ষা করা এতটা জরুরি হয়ে পড়েছে। টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্যই প্রাকৃতিক পুঁজিকে সুরক্ষা দেওয়া দরকার। প্রতিবেশ পণ্য ও সেবার উপযুক্ত মূল্য মাপার পদ্ধতি খুঁজে পাওয়া সময়ের দাবি। তাই আমাদের সমুদ্রসম্পদের উপযুক্ত হিসাব বিবরণী (ব্যালান্স শিট) তৈরি করতে হবে। আমরা যতই সমুদ্রকে আরো বুঝব, আরো জানব ততই এসব সম্পদের সত্যিকার সন্ধান পাব। এসবের সত্যিকার মূল্য অনুভব করতে পারব। সমুদ্র ঘিরে যে অবকাঠামো ও শিল্প গড়ে উঠছে, সেসবের উপকরণ ও মূল্য মূলভূমির শিল্প বা অবকাঠামোর মূল্য থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। যে রড বা সিমেন্ট দিয়ে আমরা মূলভূমিতে রাস্তা, সেতু বা ইমারত গড়ব, সেসব দিয়ে সমুদ্রপারের অবকাঠামো গড়া যাবে না। লবণাক্ততায় ওই সব উপকরণ দ্রুতই ক্ষয়ে যাবে। তাই আলাদা করে আস্তরণ লাগানো রড লাগবে সমুদ্রের কাছাকাছি অবকাঠামো নির্মাণের সময়। তার স্থায়িত্বের জন্যই এই আস্তরণের দরকার হবে। সিমেন্টের ভেতরও বাড়তি উপকরণ যুক্ত করতে হবে। তা ছাড়া প্রাকৃতিক যেসব সংরক্ষণব্যবস্থা সমুদ্রপারে রয়ে গেছে (যেমন—ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল), সেগুলো সংরক্ষণ করাও জরুরি। তার মানে, সমুদ্রাঞ্চলের শিল্প খাতের দক্ষতা, সহিষ্ণুতা ও অবয়ব ভিন্ন হতেই হবে। সে জন্য এসবের দামও ভিন্ন হবে। এভাবেই সুনীল অর্থনীতিকে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিতে দেখতে পারলে টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি জোরদার হবে। তাই আমাদের গবেষক, নীতিনির্ধারক, প্রকৌশলী এবং জনগণকে সুনীল অর্থনীতিকে প্রতিবেশিক নয়া চোখ দিয়ে দেখতে হবে। এই অর্থনীতির বিকাশ আর পরিবেশসম্মত টেকসই উন্নয়নের ধারার মাঝে নিবিড় সংযোগ স্থাপনের কোনো বিকল্প নেই। সুনীল অর্থনীতিকে টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সমুদ্রের পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টিকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা সমুদ্রকে এক জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখতে চাই। তাকে বাঁচিয়ে রেখে, তার সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়—এমন কিছুই করা যাবে না। মানুষের সুস্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই জীবনচলা নিশ্চিত করার স্বার্থেই আমাদের সমুদ্রকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ভাবতে হবে। রক্ষা করতে হবে। আমাদের উন্নয়নের প্রধান লক্ষ্য দারিদ্র্য নিরসন ও টেকসই জীবনচলা, সেই লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থেই আমাদের সমুদ্রকে এই চোখে দেখতে হবে। এটিই সুনীল অর্থনীতির মূলকথা।

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক